Carpel Tunnel Syndrome: হাতের আঙুলে কি ব্যথা হয় ? আপনি নিশ্চয়ই ‘কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত

ডা. কে কে পাে
(লেখক: সিনিয়র ভাসকুলার ও কাঠি মোরানিক সার্কো ইয়াছ আপোলো হাসপাতাল সরিতা বিহার, নিউমিজি)

আপনি হয় তো মাঝে মাঝে অথবা সবসময়েই আপনার হাতের বুড়ো আঙুল, কিংবা তর্জনী, মধ্যমা বা অনামিকায় ব্যথা অনুভব করেন। আবার এমনও হতে পারে, হাতের এই আঙুলগুলির কোনও একটিতে কিংবা সবগুলোতেই জ্বালাভাব, কম্পন বা হঠাৎ করে অসাড় অনুভূতি বোধ করে থাকেন। কখনও মনে হয়, যেন হঠাৎ করে আপনার আঙুলগুলোতে বিদ্যুতের শক লেগেছে। কখনও এমন হয় যে, আঙুলের ব্যথা বাড়তে বাড়তে তা হাত বেয়ে কাধ পর্যন্ত উঠে যায় এবং পুরো হাতেই যেন একটা অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। কখনও কখনও রোগীরা বলেন যে, হাতের আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ে, নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। মাঝে মাঝে আঙুলগুলো বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সুক্ষ্ম কাজ, যেমন হাতে সেলাইয়ের কাজ করতে কিংবা জামার বোতাম লাগাতে খুবই অসুবিধা হয়। আবার এমনও হয়, আঙুলগুলোর অসাড়তার কারণে কোনও জিনিস ধরে রাখা খুব সমস্যা হয়। প্রায়ই হাত ফসকে জিনিস পড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিশেষ করে চায়ের কাপ হাত ফসকে পড়ে গিয়ে জামাকাপড় ভিজে যাবার ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখা যায়। উপরে উল্লেখিত কোনও একটি সমস্যা যদি আপনার ক্ষেত্রে দেখা দেয়, তাহলে সমস্ত ধরনের সম্ভাব্যতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই বলছি, আপনি অতি অবশ্যই কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম’ নামে একটি রোগে আক্রান্ত এবং আর দেরি না করে অতি দ্রুততার সঙ্গে আপনি অবশ্যই একজন ভাসকুলার সার্জনের স্মরণাপন্ন হোন।
কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম হলো আঙুলের এক ধরনের ব্যথা যা সত্যিই খুব দুর্ভোগের। হাতের এই অবস্থার সৃষ্টি হয় মূলত হাতের কবজিতে যে নার্ভ রয়েছে তার উপর ক্রমাগত চাপ বাড়তে থাকলে। যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে পরিস্থিতি ঘোরতর হয়ে উঠতে পারে। এমনকি হাতের পেশিগুলো অকেজো হয়েও যেতে পারে। শুরুতে এই সমস্যা যখন দেখা দেয়, তখন মাঝে মাঝে আঙুলে ও হাতে ব্যথা হয় এবং আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ে। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণ পর এই অবস্থা কেটে যায় এবং কোনও ধরনের সমস্যাই আর থাকে না। কিন্তু কিছুদিন পর আবার সমস্যা দেখা দেয়। এই যে হঠাৎ ব্যথা হওয়া এবং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, রোগীরা প্রথমদিকে রোগটিকে বিশেষ পাত্তা দেন না। ফলে চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়। পরিস্থিতি যখন ঘোরতর হয়ে ওঠে তখন ব্যথাসহ অন্যান্য অস্বস্তিকর অনুভূতির ফলে রাতে রোগীরা ঘুমাতে পর্যন্ত পারেন না। এভাবে ব্যথার যন্ত্রণায় নিঝুম রাত কাটাতে কাটাতে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা স্নায়ু দৌর্বল্যে ভুগতে থাকেন। অনেকের মানসিক টেনশনও তৈরি হয় যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।


কারা এ ধরনের সমস্যায় ভোগেন

বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করা গেছে যে, সমস্ত মানুষের কর্মক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই হাতের আঙুলের নড়াচড়া করতে হয় বেশি, তারাই এই কার্পেল টান্যাল সিনড্রোমে আক্রান্ত হন বেশি। দেখা গেছে, গাড়ির চালক বিশেষ করে বাস ড্রাইভার যারা দিনের বেশিরভাগ সময় গাড়ি চালন, অফিসে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে যারা কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করেন এমনকি যারা খুব বেশি পরিমাণ লেখালেখি করেন, তাদেরই এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেখা গেছে, গর্ভবতী মা, বয়স্ক মানুষ এবং যারা ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যেও এই সিনড্রোমের লক্ষণ তৈরি হয়। যারা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করেন এবং যাদের ক্রমান্বয়ে ডায়ালেসিস করতে হয়, তাদের মধ্যে এই সিনড্রোমের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। যে সমস্ত রোগী হাইপোথাইরয়েডিজম-এ আক্রান্ত অথবা যাদের মধ্যে রিউমাটরেড আর্থারাইটিস কিংবা গেঁটে বাত আছে, তারা অবশ্যই এই কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হবেনই। বিভিন্ন দুর্ঘটনাজনিত কারণে যাদের কবজির হাড় ভেঙে গেছে কিংবা স্থানচ্যুত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। যাদের হাতের কবজির হাড়ে জন্মগতভাবে ত্রুটি থাকে তারাও এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারেন। লক্ষণীয়ভাবে এটাও দেখা গেছে যে, এই কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম কোনও কোনও পরিবারে পুরুষাণুক্রমে পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।

আরও পড়ুন  :-


কীভাবে এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা সম্ভব?

যদি আপনি রাতে হাতে ও আঙুলে ব্যথা অনুভব করেন কিংবা অসাড় বোধ করেন, অথবা যদি আপনি লিখতে বা কম্পিউটারের কি বোর্ড চালাতে অসুবিধা বোধ করেন, অথবা যদি আপনি সুচ-সুতো দিয়ে এম্ব্রয়ডারি করতে অসুবিধা বোধ করেন, বা যদি ইদানীং আপনার হাত ও হাতের আঙুলগুলোতে বেশি দুর্বলতা বোধ করেন, অথবা বই বা কোনও কিছু হাতে ধরতে যদি আপনার অসুবিধা লাগে এবং হাতে ধরার পরপরই যদি সেই জিনিস হঠাৎ করে হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়, অথবা যদি মনে হয় আপনার একটি হাত অন্য হাতটির চেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে— তাহলে হয়তো আপনি কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এই অবস্থায় কোনও রকম কালবিলম্ব না করে আপনি অবশ্যই একজন ভাসকুলার সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন যাতে আপনার সময়মতো সঠিক চিকিৎসা হতে পারে।


গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা- নিরীক্ষা কিছুতেই এড়িয়ে যাবেন না

একটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি খুব সহজে নিজেই জেনে নিতে পারবেন আপনার কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম এর মতো কোনও রোগ সৃষ্টি হয়েছে কিনা। একটি টেবিলের উপর আপনার হাতের কনুইটি রেখে হাতের কবজিটি টেবিলের উপর সোজাসুজি করে রাখুন। কবজিটি দু’দিকে বাঁকিয়ে নিলে যদি আপনার হাতের আঙুলে হালকা ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে আপানার কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন রোগীকে। এই দু’টি পরীক্ষা হলো ‘নার্ভ কনডাকশন ভেলোসিটি’ বা ‘এন সি ভি’ এবং অন্যটি হলো ‘ইলেকট্রোমায়োগ্রাম’ বা ‘ই এম জি’। এই দু’টি পরীক্ষার সাহায্যে নির্ণয় করা যায় যে কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং এর ফলে আক্রান্ত হাতের নার্ভ ও পেশী কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি হাতের আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষাও আক্রান্ত হাতের নার্ভে কতটা চাপ রয়েছে তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এক্ষেত্রে এক্সরে-ও করা হয়ে থাকে। এই পরীক্ষার সাহায্যে নির্ধারণ করা হয় হাতে আগে থেকেই কোনও আঘাতের কারণে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কিনা কিংবা কবজিসহ হাত ও আঙুলের হাড়ের বিভিন্ন জয়েন্টে কোনও অস্বাভাবিক স্ফীত রয়েছে কি না। উপরোক্ত পরীক্ষাগুলোর পাশাপাশি চিকিৎসকরা আরও নিশ্চিত হতে হাতের এম আর আই করে থাকেন। এতে হাতের নার্ভে পুরানো আঘাতজনিত কোনও চাপ রয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।


কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম এর চিকিৎসা

প্রথমত কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম-এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথমেই জানতে হবে যে এই সমস্যাটি একটি গুরুতর সমস্যা। একে কিছুতেই উপেক্ষা করা উচিত হবে না। কারণ অজ্ঞতা ও উদাসীনতা এই রোগকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যার ফলে পরবর্তী স্তরে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের আর কোনও উপায় থাকে না। যদি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এটা দেখা যায় যে এই সমস্যা ততটা মারাত্মক নয় তাহলে কিছু ঔষধপত্র ও নিয়মিত এক্সারসাইজে এই রোগ থেকে নিরাময় সম্ভব। যারা এই রোগে আক্রান্ত তাদের সবসময়েই হাত সোজা করে রাখতে হবে এবং হাজের কবজি কখনো বেঁকিয়ে রাখা যাবে না। রাতে ঘুমের সময় যদি কারও হাতের কবজি বাঁকিয়ে রাখার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে তাকে অবশ্যই ঘুমানোর সময় একটি বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি স্প্রিন্ট পরতে হবে। এতে রাতে ঘুমে কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। কখনও কখনও ব্যথানাশক ঔষধও দেওয়া হয় ব্যথা কমানোর জন্য যা রোগীকে ব্যথা থেকে স্বস্তি দেয়। কখনও কখনও ব্যথা কমানোর জন্য স্টেরয়েড ইনজেকশনও দেওয়া হয় এবং এতে বেশ স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে স্টেরয়েড ইনজেকশন এই রোগের কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।


কখন সার্জারি প্রয়োজন ?

যখন দেখা যায় যে, একজন রোগী ঔষধ সেবন এক্সারসাইজের পরও কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম থেকে মুক্তি পাননি এবং দিনভর চব্বিশ ঘণ্টাই ক্রমাগত ব্যথা হতে থাকে এমনকি এই ব্যথার চোটে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হয় তাকে, তখন চিকিৎসকদের কাছে অপারেশন ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। এই অপারেশনের ফলে একদিকে যেমন ব্যথা ও হাতের কম্পন অবস্থা সেরে যায়, তেমনি হাতের এই অপারেশন নিয়ে অযথা ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। কারণ এটা খুবই সাধারণ অপারেশন এবং অপারেশন শেষে সেদিনই রোগীরা তাদের বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। একমাত্র সার্জারির মাধ্যমে কার্পেল টান্যাল সিনড্রোম এর কারণে হাতের বিভিন্ন নার্ভের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয় তার থেকে পুরোপুরি রেহাই পাওয়া যায়।

Leave a Comment