জীবন রক্ষার যাদু: CPR-এর প্রয়োজনীয়তা এবং পদ্ধতি

জীবন রক্ষার যাদু: CPR-এর প্রয়োজনীয়তা এবং পদ্ধতি
মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর জন্য কি ভাবে সিপিআর দিতে হয় তার পদ্ধতি দেখাচ্ছেন দুজন ডাক্তার

CPR কী এবং এর গুরুত্ব

হঠাৎ অসুস্থ হওয়া, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে যাওয়া, এই সময়ে কারো জীবন বাঁচানোর জন্য CPR খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এই সময়ে জরুরী প্রাথমিক চিকিৎসা জানা একটি আশীর্বাদ হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, যাকে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সংক্ষেপে ‘CPR’ বলা হয়।

CPR কখন এবং কেন দরকার

যদি কেউ অসুস্থতার জ্ঞ্যান হারায়, যদি তার হৃদস্পন্দন থেমে যায় বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেই ব্যক্তিকে CPR দিতে হবে। এর মাধ্যমে, ব্যক্তির ফুসফুসে অক্সিজেন দেওয়া হয়, সেইসাথে শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হয়, যা জীবন বাঁচাতে সহায়ক হয়।

CPR -এর গুরুত্ব এবং প্রশিক্ষণ

সিপিআর হল বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির একটি। বিভিন্ন নাটক বা চলচ্চিত্রে অনেকেই দেখবেন যে অজ্ঞান ব্যক্তির বুকে দুই হাত দিয়ে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং মুখে শ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে সেই ব্যক্তির জ্ঞ্যান ফিরে আসছে। এটিকেই CPR বলা হয়। তবে এর সঠিক পদ্ধতি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কোন ক্ষেত্রে সিপিআর দেওয়া যাবে তাও জানা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই CPR প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বিভিন্ন বিশেষ বাহিনী এবং সংগঠনের লোকজনকেও সিপিআর প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

 সাধারণ মানুষের জন্য CPR

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সাধারণ মানুষেরও নিজেদের সুবিধার্থে CPR প্রক্রিয়া জানা উচিত। যা অনেক দেশের ছোট থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে, অনেকেই এই জীবনরক্ষাকারী CPR সম্পর্কে সচেতন নন।

কখন CPR দিতে হবে

“যদি আপনার সামনে কারো কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন এবং CPR দিতে শুরু করুন,” ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন এমনটাই বলছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগও একই কথা বলছে। তাদের ভাষায়, “যদি কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিকভাবে শ্বাস না নেয়, তাহলে CPR দেওয়া শুরু করতে হবে।”

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট যে কারো হতে পারে

ডাক্তাররা বলছেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কার্ডিয়াক রোগীদের হতে পারে, এবং অ-কার্ডিয়াক রোগীদেরও, যাদের হৃদরোগ নেই। এমন ক্ষেত্রে যদি কেউ আঘাত পায় বা পড়ে যায়, তাহলে দেখা যায় তার হৃদয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাকে বাঁচানোর জন্য সিপিআর দিতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি হৃদরোগ থেকে হতে পারে, যেমন বৈদ্যুতিক শক, গুরুতর আঘাত, পানিতে ডুবে যাওয়া, বড় সংক্রমণ, বিভিন্ন কারণে যা হৃদয় বন্ধ করে দেয়। আর ডাক্তাররা জরুরী ভিত্তিতে CPR দিতে বলছেন।

সিপিআরের সাতটি ধাপ

রেড ক্রস সিপিআরের সাতটি ধাপ উল্লেখ করেছে। যেখানে প্রথম ধাপ হল নিরাপত্তা দিকটি দেখা। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তির চারপাশে আগুন বা পানি ইত্যাদি বিপদজনক কিছু আছে কিনা, সে কি রাস্তার মাঝখানে আছে কিনা, ইত্যাদি। প্রয়োজনে পিপিই বা পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

আরো পড়ুন:- অনিদ্রা এবং মানসিক চাপ: সুস্থ থাকার উপায় এবং প্রতিকার

Protection of children in summer: গরমের প্রভাব থেকে শিশুদের কিভাবে রক্ষা করবেন?

দ্বিতীয় ধাপ হল দেখা যে ব্যক্তি কোন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে কিনা। এজন্য তাকে ধাক্কা দিতে হবে এবং জোরে ডাকতে হবে। একই সাথে নিশ্চিত করতে হবে যে কোন রক্তপাত নেই। যদি ব্যক্তি কোন প্রতিক্রিয়া না দেয় এবং শ্বাস না নেয়, তার পালস না থাকে বা সে হাঁপায়, তাহলে তৃতীয় ধাপে সাহায্য ডাকতে হবে।

এরপর চতুর্থ ধাপে ব্যক্তির পাশে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে। এ সময় হাত কাঁধের সামনে থাকবে এবং ব্যক্তিকে চিত করে ফ্ল্যাটভাবে শোয়াতে হবে।

পঞ্চম ধাপে আসল CPR শুরু হবে। প্রথমে দুই হাত সেই ব্যক্তির বুকে স্থাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এক হাত অন্য হাতের উপর রাখতে হবে এবং আঙুলগুলো একসাথে জড়িয়ে দিতে হবে। চাপটি যেন কমপক্ষে দুই ইঞ্চি গভীরে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি বার চাপ দেওয়ার পরে চাপ ছেড়ে দিতে হবে যেন বক্ষ আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে। এর গতি হবে প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার। তবে ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর বিরতি নিতে হবে। এরপর ষষ্ঠ ধাপে মুখ দিয়ে শ্বাস দিতে হবে। এজন্য মাথা সোজা করে ঠোঁটে চাপ দিয়ে মুখটি ঢেকে দিতে হবে। এরপর ব্যক্তির নাক থেকে স্বাভাবিক শ্বাস নিতে হবে এবং মুখে পুরো শ্বাস দিতে হবে। এর স্থায়িত্ব হবে এক সেকেন্ড এবং নিশ্চিত করতে হবে যে বক্ষ সামান্য ফুলে ওঠে। এরপর পরের শ্বাস তুলে নিয়ে বাতাস বের করে দিতে হবে।

তবে এ ক্ষেত্রে যদি প্রথমবার বক্ষ ফুলে না ওঠে, তাহলে মাথা আবার সোজা করে গলা বা মুখের ভিতর কিছু আটকে আছে কিনা দেখতে হবে, যা শ্বাস নেয়ার বাধা সৃষ্টি করছে।

শিশুদের CPR

অনেক সময় ছোট শিশুরাও CPR প্রয়োজন। অর্থাৎ, তাদের হৃদরোগের চেয়ে বেশি, শ্বাসের সমস্যা হলে সিপিআর প্রয়োজন হতে পারে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা বলছে, শিশুদের CPR দেওয়ার সময় কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত। প্রথমে, একটি হাত কপালে রেখে মাথা পেছনে সোজা করতে হবে। যদি মুখ বা নাকে কিছু আটকে থাকে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর নাক থেকে মুখে পাঁচবার শ্বাস দিতে হবে এবং একই সময়ে বুকের উপরে নজর রাখতে হবে। এরপর একটি হাতের তালু শিশুর বুকে রেখে প্রায় ৫ সেন্টিমিটার (প্রায় দুই ইঞ্চি) গভীর পর্যন্ত চাপ দিতে হবে।

এই গভীরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি এক হাতে সম্ভব না হয়, তাহলে দুই হাতের তালু ব্যবহার করা যেতে পারে।আর এক বছরের নিচে শিশুর ক্ষেত্রে, দুই হাতের বদলে দুটি আঙুল ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে চাপের গভীরতা হবে ৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ইঞ্চি।

বয়স্কদের মতোই, প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার চাপ দেওয়ার গতি বজায় রাখতে হবে, টানা ৩০ বার চাপ দিয়ে, দুইবার মুখ দিয়ে শ্বাস দিতে হবে।

শিশুদের ক্ষেত্রে, CPR চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো সাহায্য আসে।

CPR জানা কতটা গুরুত্বপূর্ণ

অনেক ক্ষেত্রে, রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। সেই ক্ষেত্রে, CPR জানলে জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

Leave a Comment