Auto Brewer’s Syndrome: শরীর নিজেই বানায় মদ, হয় মাতাল! কী সেই বিরল রোগ?

Auto Brewer’s Syndrome রোগের কিছু কথা – সম্প্রতি একজন বেলজিয়ান ভদ্রলোক সংবাদের শিরোনাম হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। যদিও তার শরীরে নির্ধারিত সীমার তিনগুণ অ্যালকোহল পাওয়া যায়, তিনি দাবি করেন এক ফোঁটাও মদ পান করেননি। অবশেষে চিকিৎসকদের সহায়তায় প্রমাণিত হয় যে, তিনি অ্যালকোহল পান করেননি বরং এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার নাম Auto Brewer’s Syndrome (অটো ব্রুয়ারি সিনড্রোম)।

Auto Brewer's Syndrome: শরীর নিজেই বানায় মদ, হয় মাতাল! কী সেই বিরল রোগ?
শরীর নিজেই বানায় মদ, হয় মাতাল!

কী এই “Auto Brewer’s Syndrome” বা এ বি এস?

যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনের একটি হাসপাতালের বিছানায় ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন রে লুইস নামের এক রোগী। দুটি বিষয় তাকে ভাবাচ্ছে, কিন্তু, সেগুলোর ব্যাপারে তার মনে কোনও সন্দেহ নেই, পুরোপুরি নিশ্চিত তিনি। প্রথমটি, ১১ হাজার জীবন্ত স্যামন মাছসহ দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ট্রাকটির জন্য তাকে ভালোই বিপদে পড়তে হবে। মাছগুলো ফিস অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ ডিপার্টমেন্টের, তিনি সেখানকার একজন প্রযুক্তিবিদ। আর দ্বিতীয়টি, যতই পুলিশের লোকেরা লিখুক না কেন যে, তার রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বেশি, দুর্ঘটনার রাতে লুইস মদ খাননি। সেই দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে। রে লুইস বলছিলেন, “বরফ জমা রাস্তায় দুই ঘণ্টা ট্রাক চালাতে হবে, এটা তো আমি জানতাম। আমি এক ফোঁটা মদও ছুঁয়ে দেখিনি।” দুর্ঘটনার আট মাস পর ৫৪ বছর বয়সি এই বায়োটেকনিশিয়ান জানতে পারলেন তার এ বি এস আছে। আরও জানলেন, নিজের শরীরই তাকে মাতাল বানিয়েছে। 

আরো পড়ুন:- ক্যান্সারের সাথে লড়াই: ফোসিপির সমর্থন এবং প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব

অনিদ্রা এবং মানসিক চাপ: সুস্থ থাকার উপায় এবং প্রতিকার

Auto Brewer’s Syndrome (এ বি এস) এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর নিজেই অ্যালকোহল উৎপাদন করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মদ্যপান না করলেও তাদের রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং তারা মদ্যপ অবস্থায় থাকেন। এ বি এসকে গাট ফারমেন্টেশন সিনড্রোমও বলা হয়। এই রোগে মুখ, পাকস্থলী বা মূত্রনালীর ব্যাকটেরিয়া শর্করাকে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে, যা রক্তপ্রবাহে মিশে যায় এবং মদ্যপানের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে।

কাদের মধ্যে এ বি এস দেখা দেয়?

Auto Brewer’s Syndrome খুবই বিরল একটি রোগ। ২০২১ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে এমন উদাহরণের সংখ্যা একশোরও কম। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এ রোগটি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে শনাক্ত হয় না।

ডায়াবেটিস, ওবেসিটি বা অন্ত্রের প্রদাহের মতো রোগের সঙ্গে এ রোগের সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া, কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়ার মতো ঔষধ গ্রহণ করলে এ বি এসের সম্ভাবনা বাড়ে।

এ বি এস কী?

এ বি এসকে গাট ফারমেন্টেশন সিনড্রোমও বলা হয়। এটি দেহের এক রহস্যময় অবস্থা যা রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রোগী অল্প অ্যালকোহল গ্রহণ করুক কিংবা একেবারেই না গ্রহণ করুক, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় মুখ, পাকস্থলী বা মূত্রনালীর ব্যাকটেরিয়াগুলো চিনি ও অন্যান্য শর্করা গ্রহণ করে সেগুলোকে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে। প্রক্রিয়াটি এন্ডোজেনাস অ্যালকোহল প্রোডাকশন নামেও পরিচিত। এ বি এসের প্রতিক্রিয়ায় কথা জড়িয়ে আসে, হাঁটাচলা এলোমেলো হয়ে যায় এবং হ্যাংওভার অস্বস্তিকর অনুভূতি) হয়। (রোগটির অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ১৯৪০ এর দশকে যখন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে উগান্ডার এক হাসপাতালের চিকিৎসকদের করা একটি ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সি ছেলে শিশুটির পাকস্থলী ফেটে গিয়েছিল। পরিপাকতন্ত্রে সার্জারির সময় “একটা তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়…যা স্পষ্টতই অ্যালকোহলিক বা মাদকসম্পৃক্ত।” কারা আক্রান্ত হন? 

এ বি এস খুবই বিরল রোগ। ২০২১ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এমন উদাহরণ একশোটিরও কম। যদিও, কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক ঘটনাই আড়ালে রয়ে গেছে। রোগটির কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা। পরিপাক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মানব শরীর পাকস্থলীতে কিছুটা অ্যালকোহল তৈরি করে থাকে। কিন্তু, বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে রক্তে যাওয়ার আগেই ‘ফার্স-পাস মেটাবলিজম’ নামে এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটুকু শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

“আমাদের সবার শরীরেই প্রাকৃতিকভাবে সামান্য অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। কিন্তু, এ বি এসে আক্রান্তদের শরীর খুব বেশি পরিমাণে এটি উৎপাদন করে যা রক্তপ্রবাহে মিশে যায়,” ব্যাখ্যা করছিলেন ড. রিকার্ডো জর্জি দিনিস-অলিভিয়েরা, যিনি পর্তুগালভিত্তিক একজন বায়োমেডিক্যাল কনসালট্যান্ট ও ফরেনসিক এক্সপার্ট। এই রোগটি নিয়ে কয়েকটি গবেষণাপত্রও আছে তার। তার কথায়, “দুঃখজনক হলো, রোগটা যে আছে, এটা জানতে হলেও কাউকে ক্রিমিনাল চার্জের মতো নাটকীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।” তার ভাষায় এ বি এস একটা “পারফেক্ট মেটাবলিক স্টর্ম” বা বিপাকীয় বিপর্যয় যাতে কয়েকটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে শুরু করে। প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আগে থেকেই ডায়াবেটিস, ওবেসিটি (স্থূলতা) বা অন্ত্রের প্রদাহের মতো রোগের উপস্থিতি থাকে। দ্বিতীয়ত, রোগীরা কী ধরনের ঔষধ গ্রহণ করেন তার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত। যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন ঔষধ গ্রহণ করা, যেগুলো আমাদের পেটে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এ বি এসের সঙ্গে বসবাস

পরিবারের সঙ্গে থ্যাংকসগিভিং ডিনারে ছিলেন জো কর্ডেল। ডিনারের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের এই নার্স। জ্ঞান হারানোর আগে যখন কথা জড়িয়ে আসছিল, তিনি ভেবেছিলেন, টার্কি বেশি খেয়ে ফেলায় তার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু, এরপর একদিন টেক্সাস হাসপাতালে শিফট চলাকালীন তার বিরুদ্ধে মাতাল হওয়ার অভিযোগ তোলেন এক সহকর্মী, যা রীতিমতো চাকরি যাওয়ার মতো অপরাধ। “লোকে ভাবতো আমি অ্যালকোহলিক,” ৭৫ বছর বয়সী কর্ডেল সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “ওরা বলতো, আমার নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।” “লজ্জিত আর বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়লাম। আমি কাজপাগল মানুষ ছিলাম, একদিনও কামাই দিইনি।” একটা সময় তার স্ত্রী ও সহকর্মী বারবারাও সন্দেহ করতে থাকেন যে তার মদ্যপানের নেশা আছে। স্বামীকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ফলে সারা ঘর খুঁজতেন মদের বোতল লুকানো আছে কিনা।

এছাড়া ঘরে যা মদ ছিল সেগুলোর উপরও কড়া নজর রাখতেন বারবারা। তার বক্তব্য, “প্রথমে আমি জোকে সন্দেহই করেছিলাম।” “ঘরে থাকা বোতলগুলোতে দাগ দিয়ে রাখতাম আমি। পরীক্ষা করে দেখতাম তাতে পরে জল মেশানো হয়েছে কিনা।” সন্দেহ আর অভিযোগের কারণে জো আতঙ্কে থাকতেন, কখন হুট করে তার মাতাল সময়টা চলে আসে! “এত বিরক্তিকর লাগতো, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভয়ানক একটা সময় পার করতাম,” বলছিলেন তিনি।

উপসর্গ টের পাওয়ার বছর চারেক পরে ২০১০ সালে জো’র এ বি এস শনাক্ত হয়। চাকরিটা বাঁচাতে সমর্থ হন ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে হতো তাকে।

এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে বারবারা একটি সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করেন। “অটো-ব্রুয়ারি সিনড্রোম অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসার্চ” নামের প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা সাড়ে আটশোর কাছাকাছি। তিনি বলেন, “রোগীদের কাছে নিয়মিত শুনি ডাক্তাররা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন।” “আরও বাজে ব্যাপার হলো, তারা অপমানের শিকার হন, মিথ্যুক সাব্যস্ত হন এমনকি ভুয়া রোগ নিয়ে আসার অভিযোগও তোলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আর নাহলে, নামমাত্র চিকিৎসা পান।” তিনি আরও বলেন, যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান শুরুর পর তাদের অনেকে অ্যালকোহল উইথড্রোয়াল সিম্পটমের বিষয়ে বানিয়ে বলতে থাকেন। “সময়ের সঙ্গে মদ্যপানে অভ্যস্ত এবং নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে ফিলিংস অফ উইথড্রোয়াল (নিজেকে সরিয়ে আনার অনুভূতি) এড়াতে চান তারা।” “একসময় অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হতো আমার, কিন্তু গত ১০ বছর ধরে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারছি।’

Auto Brewer’s Syndrome (এ বি এস) রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা

এ বি এসের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে কথা জড়িয়ে আসা, হাঁটাচলা এলোমেলো হয়ে যাওয়া এবং হ্যাংওভার। রোগটি শনাক্ত করার জন্য ডাক্তাররা রোগীর পরিপাকতন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর পরীক্ষা করেন। গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ টেস্টও করা হয়, যাতে খালি পেটে শর্করাযুক্ত খাবার গ্রহণের পর রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসার জন্য কিছু ঔষধ এবং কম শর্করাযুক্ত ডায়েট দেওয়া হয়। এ বি এস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফুড সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করা হয়। যাদের এ রোগটি শনাক্ত হয়, তারা প্রায়ই নির্দিষ্ট ডায়েট মেনে চলেন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেন।

Auto Brewer’s Syndrome (এ বি এস) একটি রহস্যময় রোগ হলেও এর যথাযথ চিকিৎসা এবং জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চললে রোগীরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যথাযথ চিকিৎসা ও সহায়তা পেতে সক্ষম হবেন।

Leave a Comment