শহরের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে রোজ বাজার করার সময় খুব কমই মেলে। তাই ফ্রিজ (refrigerator) খুবই প্রয়োজন। সময় বাঁচাতে অনেকেই সপ্তাহ বা মাসের বাজার একবারে সেরে ফেলেন, কিংবা সুবিধামতো বাজার করে সময়ের জন্য মাছ-মাংস, সবজি সংরক্ষণ করে রাখেন। এ ক্ষেত্রে, সহজেই পচে যাওয়া খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করাটা খুবই জরুরি।

যদি এসব খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হয়, তবে সেগুলোর গুণগত মান ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি খাবারে জীবাণুও প্রবেশ করতে পারে, যা খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। মাছের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। সংরক্ষণের ভুলে মাছ নষ্ট হয়ে যায় এবং স্বাদ ও গন্ধ বদলে যায়।
তবে ভালো মানের ডিপ ফ্রিজে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে মাছ দু’তিন মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে ছোট মাছের ব্যাপারটি একটু আলাদা। এগুলো খুব সহজেই পচে যায় এবং টাটকা অবস্থায় খেয়ে ফেলা উচিত। ফ্রিজে রাখলেও ছোট মাছ সর্বোচ্চ এক মাস ভালো থাকে।
মিঠা জলের মাছ
- মাঝারি বা বড় আকারের মাছ আস্ত অবস্থায় সংরক্ষণ করতে পারেন। গোটা অবস্থায় রাখলে লেবুর রস মাখিয়ে রাখতে পারেন।
- এসব মাছ টুকরো করেও রাখা যায়। এভাবে রাখলে লবণ-হলুদ মাখিয়ে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিতে পারেন। সবশেষে লেবুর রস মাখিয়ে নিন। চাইলে না ধুয়েও লবণ আর লেবুর রস মাখিয়ে রাখতে পারেন।
ইলিশ মাছ
ইলিশ মাছ সংরক্ষণের পদ্ধতি একটু ভিন্ন। ইলিশ ফ্রিজে রাখার আগে ধোয়া যাবে না এবং অবশ্যই গোটা অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে। মাছের গায়ে ময়লা থাকলে শুধু হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলুন।
শুঁটকি মাছ
শুঁটকি মাছ ফ্রিজের বায়ুরোধী বাক্সে বা পলিথিনে ভালোভাবে মুড়ে রেখে দিতে পারেন। এতে শুঁটকির ঘ্রাণ ঠিক থাকবে। শুকনা শুঁটকি বাইরেই রাখা যায়, তবে ভেজা ধরনের শুঁটকি ফ্রিজ বা ডিপ ফ্রিজে রাখতে হয়।
সামুদ্রিক মাছ
একটি মাছকে তিন-চারটি বড় টুকরো করে নিন। এরপর বায়ুরোধী বাক্সে এমনভাবে জল নিন, যাতে মাছের টুকরোগুলো পুরোপুরি ডুবে থাকে। এভাবে বাক্সটি ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলে মাছের টুকরোগুলো সুন্দরভাবে বরফে থাকবে। গোটা মাছ বরফ করে রাখলে বেশি ভালো হয়, তবে সাধারণত ফ্রিজে এতটা জায়গা থাকে না। মাছের টুকরোয় সামান্য লেবুর রস মাখিয়ে নিতে পারেন।
সব মাছ সংরক্ষণের জন্য সাধারণ নির্দেশনা
- যেকোনো মাছ কেনার সময় সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে। যদি বাজার থেকেই মাছ কিছুটা পচা অবস্থায় কিনে আনা হয়, তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করেও খুব একটা লাভ হবে না।
- মাছ সংরক্ষণের সময় কোনো মাছ নরম হয়ে গেলে পেট পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নিন। এরপর ফ্রিজে না রেখে বাইরেই রাখুন।
- বায়ুরোধী বাক্সে মাছ সংরক্ষণ করতে পারেন। যেসব মাছ পলিথিনে রাখা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে পলিথিনের মুখ ভালোভাবে মুড়ে রাখুন। আর ছোট মাছের জন্য ভালো মানের পলিথিন ব্যবহার করুন।
- মাছ এমনভাবে ভাগ করে সংরক্ষণ করুন, যাতে কোনো ভাগ একবার ফ্রিজ থেকে নামানো হলে আবার ওঠানোর প্রয়োজন না হয়। অর্থাৎ, একবারে যতটুকু প্রয়োজন হবে, শুধু ততটুকুই এক ভাগে রাখুন।
- প্রতিটি ভাগে সংরক্ষণের তারিখ লিখে রাখুন। কাগজটি এমনভাবে রাখবেন যাতে প্যাকেট বা বাক্সটি হাতে নিলেই তারিখটি দেখা যায়। এতে মাছ বেশি দিন ফ্রিজে থাকলেও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কমবে।
এভাবে মাছ সংরক্ষণ করলে শহুরে ব্যস্ত জীবনে সহজেই সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর খাবার উপভোগ করা সম্ভব।
মাংস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি, কারণ এতে মাংসের তাজা ভাব, স্বাদ এবং নিরাপত্তা বজায় থাকে। মাংস সংরক্ষণের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা নিচে দেওয়া হলো:
১. রেফ্রিজারেশন (ফ্রিজে রাখা)
- তাপমাত্রা: মাংস ফ্রিজে ০ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩২ থেকে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় রাখুন। এতে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়।
- প্যাকেজিং: যদি মাংসের প্যাকেট খোলা না হয়, তাহলে তার মূল প্যাকেজিংয়ে রেখে দিন। খোলা প্যাকেট হলে, মাংস ভালো করে প্লাস্টিক র্যাপ, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মুড়ে রাখুন বা এয়ারটাইট কন্টেইনারে রাখুন, যাতে মাংসে বাতাস ঢুকতে না পারে এবং অন্য খাবারের সঙ্গে মিশে না যায়।
- সংরক্ষণের সময়সীমা:
– গরু, ভেড়া, এবং শূকর মাংস: ৩-৫ দিন।
– পোল্ট্রি (মুরগি, টার্কি): ১-২ দিন।
– মাংস কিমা: ১-২ দিন। - কিউরড মিট (হ্যাম, সসেজ): এক সপ্তাহ পর্যন্ত, মাংসের ধরনের ওপর নির্ভর করে।
২. ফ্রিজিং (ডিপ ফ্রিজে রাখা)
- তাপমাত্রা: মাংস -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা এর নিচে ফ্রিজ করুন
- প্রস্তুতি: ফ্রিজ করার আগে প্যাকেজ থেকে যতটা সম্ভব বাতাস বের করে দিন। ফ্রিজার পেপার, ভ্যাকুয়াম সিল্ড ব্যাগ, বা শক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করুন যাতে মাংস ফ্রিজার বার্ন না হয়।
- পোর্শনিং: মাংসের টুকরো এমনভাবে ভাগ করে ফ্রিজ করুন, যাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি না গলাতে হয়।
- সংরক্ষণের সময়সীমা:
– গরু, ভেড়া, এবং শূকর মাংস (সম্পূর্ণ টুকরো): ১২ মাস পর্যন্ত।
– মাংস কিমা: ৩-৪ মাস।
– পোল্ট্রি (সম্পূর্ণ): ১২ মাস।
– পোল্ট্রি (টুকরো): ৯ মাস।
– লেবেলিং: প্যাকেটে তারিখ ও মাংসের ধরন লিখে রাখুন যাতে সংরক্ষণের সময়সীমা ট্র্যাক করা যায়।
৩. গলানো (থ’ করা)
- ফ্রিজ: মাংস ধীরে ধীরে এবং নিরাপদে গলানোর জন্য ফ্রিজে রাখুন। মাংস একটি প্লেট বা কন্টেইনারে রাখুন যাতে রস পড়ে না যায়
- ঠান্ডা জল: দ্রুত গলানোর জন্য মাংসকে ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে রাখুন এবং প্রতি ৩০ মিনিটে জল পরিবর্তন করুন। নিশ্চিত করুন যে মাংসের ব্যাগ লিক প্রুফ।
- মাইক্রোওয়েভ: মাইক্রোওয়েভের ডিফ্রস্ট সেটিং ব্যবহার করে দ্রুত গলিয়ে নিন, কিন্তু এরপরেই রান্না করে নিন কারণ কিছু অংশ রান্না হয়ে যেতে পারে।
৪. ক্রস-কন্টামিনেশন এড়ানো
- কাঁচা মাংস ফ্রিজের নিচের তাকগুলোতে রাখুন যাতে রস অন্য খাবারের ওপর না পড়ে।
- কাঁচা মাংসের জন্য আলাদা কাটিং বোর্ড, বাসনপত্র এবং সংরক্ষণ পাত্র ব্যবহার করুন যাতে রান্না করা খাবারের সঙ্গে মিশে না যায়।
৫. মাংস মেরিনেট করা
- মাংস রেফ্রিজারেটরে মেরিনেট করুন, কখনই ঘরের তাপমাত্রায় নয়।
- এক ঘন্টার বেশি সময় মেরিনেট করলে ঢেকে ফ্রিজে রাখুন।
- কাঁচা মাংসের মেরিনেড পুনরায় ব্যবহার করবেন না, যদি না তা প্রথমে সিদ্ধ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ- ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ | viral fever symptoms : সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা
এই সংরক্ষণ পরামর্শগুলি মেনে চললে, আপনি মাংস তাজা ও নিরাপদ রাখতে পারবেন, ফলে অপচয় কমবে এবং খাবারের মানও ভাল থাকবে।