ঔষধ খেয়েও ফুট আলসার বা পায়ের ক্ষত কেন সারছে না, কলকাতা শহরেই চিকিৎসকরা গবেষণা করে তার কারণ খুঁজে বের করতে সফল হয়েছেন। চিহ্নিত করা গেছে ক্ষত না সারার পিছনে দায়ী একটি ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্বকে। গবেষণার এই সাফল্যে ভবিষ্যতে ফুট আলসারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় অনেক সুবিধা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রথমবার ক্লিনিকে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। মধুমেহ রোগী, পায়ে তার ক্ষত। এরজন্য কোনও অ্যান্টিবায়োটিক তিনি আগে পাননি বলেই জানিয়েছেন। তখন চিকিৎসক হয়তো তাকে ‘পেনিসিলিন’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। কিন্তু ক্ষত সারলো না। এরপর তাকে আরও একটি নতুন ‘সিফোক্সিটিন’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলো, তাতেও কোনও কাজ হলো না। চিকিৎসক আরও একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করলেন কিন্তু এতেও রোগী সুস্থ হলো না। এরপর এমন একটি দিন এল যখন ফুট আলসারের কারণে তার পা অপারেশন করে কেটে বাদ দিতে হলো। অনেক সময় আবার সেই ক্ষত থেকে সেপটিকস হয়ে যায়। কেন ঘটে এমনটা? কে দায়ী এর পিছনে? চিকিৎসকদের কাছেও জানাছিল না এমন অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্সের এক বিজ্ঞানী ও তার ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ কয়েক বছরের গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যাচ্ছে, এর মূল কারণ হলো একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। যার নাম ‘মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস’।
একজন ফুট আলসার রোগীর ক্ষতে কত রকমের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে তা খুঁজে বের করতে গিয়ে উঠে এসেছে এমনই এক ভয়াবহ চিত্র। দেখা যাচ্ছে রোগী এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হবার পূর্বেই অ্যান্টিবায়োটিক না খেয়েই ‘মাল্টি ড্রাগ প্রতিরোধী’ (এম ডি আর) হয়ে উঠেছেন। কিভাবে ঘটছে এই ঘটনা? তারও উত্তর খুঁজে পেয়েছেন জিন বিজ্ঞানী ও গবেষক ছাত্র-ছাত্রীরা। প্রায় ৫০ জন এমন রোগে আক্রান্ত রোগীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সেই ব্যাকটেরিয়ার ডি এন এ মাইক্রো বায়োমসিকোয়েন্স করে দেখা যায় ষাট শতাংশ রোগীরই শুধু এই মেথিসিলিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, এমন আরও ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যাতে তিন-চারটে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন রোগী। যার কারণে চিকিৎসক নানা রকমে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ প্রয়োগ করলেও রোগী কোনোভাবেই সুস্থ হচ্ছেন না বা তার পায়ের ক্ষত নিরাময় হয়ে উঠছে না।
জিন বিজ্ঞানী শৌভিক মুখার্জি ও তার সহযোগী একদল গবেষক কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে ডায়াবেটিক ফুট আলসার ক্লিনিক ও ডায়াবেটিক ইউনিটে আসা রোগীদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাপাতালের খ্যাতনামা চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এই গবেষণায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মূলত তার সহযোগিতায় এই গবেষণায় নতুন পথ খুলে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োটেকনলোজি দপ্তরের আর্থিক সহায়তায় ফুট আলসার রোগীদের ক্ষতস্থানে কত রকমের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই মারাত্মক চিত্র উঠে এসেছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এই ‘মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস’ ব্যাকটেরিয়া থাকলে ডায়েবটিক রোগীর ফুট আলসার কিংবা অন্য ক্ষত শুকোতে বিলম্ব হয়। গবেষণায় দেখা গেছে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। শুধুমাত্র রোগী আক্রান্ত হওয়ার পরই এই ব্যাকটেরিয়া মানব দেহে বাসা বাঁধছে আদতে তা নয়। মানব দেহের যে সব জায়গায় স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস বেশি পাওয়া যায় রোগীদের সেই নাক- ত্বক থেকে নমুনা সংগ্রহ করে দেখা গেছে ফুট আলসার হওয়ার আগে থেকেই নাকে এই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে এবং যার প্রাদুর্ভাব অনেকটাই বেশি। ত্বকেও তা পাওয়া যাচ্ছে। গবেষণায় নাকে এই ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান দিয়েছিলেন চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। বন্দিত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘স্প্রিঞ্জার’এ এই গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ দেশে প্রায় ৭১ মিলিয়ন রোগী এই মধুমেহ রোগে ভোগেন। যার মধ্যে ২৫ শতাংশ রোগীর কোনও না কোনও সময় এই ফুট আলসারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার ৩০ শতাংশ রোগী এই রোগের চিকিৎসা করালেও কোনও মুক্তি মেলে না, যার ফলে তাদের অঙ্গহানি ঘটে থাকে।
আরও পড়ুন :-
শৌভিক মুখার্জি জানান, এই গবেষণায় তারা মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস ব্যাকটেরিয়া কোন ধরনের ঔষধের প্রতি কাঠামো তৈরি করেছে তা বোঝার জন্য একটি পিসিআর বেসড কিট তৈরি করেছেন। রোগীদের নাক ও ত্বক থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এই কিট দিয়ে সহজেই ব্যাকটেরিয়া রোগীর শরীরে আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এই তথ্যের আধারে চিকিৎসকরা কোনও অসতিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রদানে বিলম্ব না করে তা বোঝতে পারেন, যাতে চিকিৎসার দিকে সথ্যঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।
এই গবেষণায় বুঝা গিয়েছে, শরীরের নাক থেকে শুরু হয়েই মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস ব্যাকটেরিয়া মোড থাকতে পারে এবং এটি যে অংশে বেশি থাকতে পারে তা মোডের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। এটি আগেই এই ব্যাকটেরিয়া বা এর প্রাদুর্ভাব থাকার প্রস্তুতির কারণে দেখা গিয়েছে, তাই চিকিৎসকরা আগামীকাল অথবা পরবর্তী কোনও সময়ে এই ধরণের রোগীদের চিকিৎসা করতে পারতে সম্মান্ধিত প্রস্তুতি নেতে পারবেন।
এই গবেষণায় নেওয়া ফলাফলের আলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকোক্কাসঅরিয়াস ব্যাকটেরিয়ার দেহে থাকা বিশেষ অংশে রোগীরা কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে এবং তার উপস্থিতি কি ধরনের জোখম তৈরি করছে। এই জ্ঞানের সাথে, চিকিৎসকরা পূর্বের চিকিৎসা পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন এবং আরও কারগরী চিকিৎসা সুবিধা তৈরি করতে পারেন।
একইভাবে, এই গবেষণা থেকে আসা তথ্য ডায়াবেটিক ফুট আলসার রোগীদের উপস্থিতি সারাদিনের জীবনের কোনও সময়ে হতে পারে এবং এটি অত্যন্ত ভদ্রভাবে পর্যালোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ যেন প্রোফেশনাল চিকিৎসকদের সাথে সঠিক যোগাযোগ এবং পূর্বাভাস করা যায়।
এই গবেষণা আগামী কিছু বছরে ডায়াবেটিক ফুট আলসার চিকিৎসা ও প্রতিরোধে নতুন পথ খুলতে সাহায্য করতে পারে। শৌভিক মুখার্জি ও তার গবেষণা দলের সদস্যরা আশা করছেন যে, এই তথ্যের ভিত্তিতে তারা পরিস্থিতি আগামীকালে ভালো করার দিকে যেতে সাহায্য করতে পারবে, যাতে ডায়াবেটিক ফুট আলসার সহিত এই জনগণকে আরও ভালো চিকিৎসা ও যত্ন প্রদান করা যায়।
এটি নতুন দিকে পুনরাকরণের পথে আমাদের সমস্ত চেষ্টা এবং প্রগতির উদাহরণ হতে পারে, তাই আমাদের আশা যেন এই গবেষণা মাধ্যমে ডায়াবেটিক ফুট আলসার চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে নতুন প্রকারের পথে এগিয়ে যাবে, যা প্রযুক্তিগত, বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক দিকে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
এই গবেষণা চালাতে গিয়ে তারা তৈরি করে ফেলেন পিসিআর বেসড একটি কিট। রোগীর শরীরের নাক ও ত্বক থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যা দিয়ে সহজেই পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যাবে ওই রোগীর শরীরে ‘মেথিসিলিন প্রতিরোধী স্ট্যাপাইলোকোক্কাসঅরিয়াস’ ব্যাকটেরিয়া রয়েছে কিনা। এটা জানা থাকলে কোন্ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যাবে না চিকিৎসকরা তা বুঝতে পারবেন। শুধু তাই নয়, যদি ওই অংশ আগে থেকে কোনও ঔষধ দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে পারেন তাহলে ডায়াবেটিক ফুট আলসার রোগীর চিকিৎসার পথও অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে। এই ফলাফলে আশা করা যায় অচিরেই ফুট আলসার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত দেখা যাবে।