কোলেস্টেরল (Cholesterol) নিয়ন্ত্রণের উপায়: ডায়েট, ব্যায়াম ও সচেতনতা

কোলেস্টেরল : বন্ধু না শত্রু?

মোটাসোটা, গোলগাল হতে আপত্তি নেই কিন্তু দেখতে হবে এই ক্ষেত্রে আপনার কোলেস্টেরলের (Cholesterol) মাত্রা ঠিক কোন পর্যায়ে আছে। যখন আপনার রক্তে চলুন রঙের চর্বিজাতীয় (fat related) বস্তুর পরিমাণ বেড়ে যায় তখন বলা হয়, কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেছে। যদি এই বস্তু ধমনীর গাত্রে (artery wall) বেশী জমা হয় তাহলে ধমনী সংকুচিত হয়ে গিয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং তার ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি হতে পারে যা মোটেই কাম্য নয়।

কোলেস্টেরল (Cholesterol) নিয়ন্ত্রণের উপায়: ডায়েট, ব্যায়াম ও সচেতনতা
কোলেস্টেরল (Cholesterol)

মজার কথা হল, কোলেস্টেরল কিন্তু মোটেই অতটা খারাপ কিছু নয়। আমাদের দেহে এটি স্বাভাবিকভাবেই তৈরী হয় এবং এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে, যেমন নতুন কোষ (cell) তৈরীতে সাহায্য করা, হরমোন (hormones) তৈরী করা এবং স্নায়ুকে রক্ষা করা। সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন এটির মাত্রা বেশী হয়ে যায়।

কোলেস্টেরলের ধরন:

কোলেস্টেরলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১) ডায়েটারী কোলেস্টেরল (Dietary Cholesterol):

এটি অধিকাংশই প্রাণীজ খাদ্যদ্রব্যতে পাওয়া যায়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডিমে ২৭৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে, যেখানে আপেলে একদম নেই।

২) সেরাম কোলেস্টেরল (Serum Cholesterol):

এই কোলেস্টেরল রক্তের মধ্যে পাওয়া যায় এবং ডাক্তাররা এটি ল্যাবোরেটরিতে পরিমাপ করেন। সেরাম কোলেস্টেরল ২০০ মিলিগ্রামের নিচে থাকা আবশ্যক।

সেরাম কোলেস্টেরলের প্রকারভেদ:

১ (ক): HDL (High-Density Lipoprotein): এটি সেরাম কোলেস্টেরলের একটি শাখা, যা ধমনীতে জমে থাকা চর্বি পরিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে। এটির মাত্রা যত বেশি হয়, ততই ভালো।

২ (খ): LDL (Low-Density Lipoprotein): এটি ধমনীতে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, তাই একে “HDL-এর দুষ্টু যমজ” বলা যায়। রক্তে এর মাত্রা যত কম থাকে, ততই মঙ্গল।

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়:

১) নিয়াসিন (Niacin): নিয়াসিন গ্রহণ করলে কোলেস্টেরল এবং LDL-এর মাত্রা কমে। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন মুখমণ্ডলে হঠাৎ রক্ত সঞ্চালন, হজমের গোলমাল এবং যকৃতের সমস্যার আশঙ্কা।

২) ভিটামিন সি (Vitamin C): এটি বয়স্কদের ক্ষেত্রে HDL-এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে ভিটামিন সি যুক্ত করলে কোলেস্টেরল কমে।

৩) ভিটামিন ই (Vitamin E): ভিটামিন ই গ্রহণের ফলে রক্তে HDL-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

৪) ক্যালসিয়াম (Calcium): ক্যালসিয়াম হৃদযন্ত্রের উপকার করে এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।

৫) ওজন নিয়ন্ত্রণ: ওজন বেশি হলে কোলেস্টেরল-এর মাত্রা বাড়ে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।

৬) ফ্যাট খাওয়া কমান: ফ্যাট কম খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। মাংস, মাখন, এবং চীজের বদলে মাছ এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার খান।

৭) অলিভ অয়েল (Olive Oil): অলিভ অয়েল বা বাদামের তেল LDL কমিয়ে HDL-এর মাত্রা ঠিক রাখে।

৮) প্রচুর বিনস্ (Beans), ফল, গাজর এবং Oats খান: বিনস্, ফল, গাজর, এবং ওটস কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

৯) রসুন খাওয়া: কাঁচা রসুন রক্তের ক্ষতিকারক চর্বির বৃদ্ধি কমাতে সাহায্য করে।

১০) কফি ও সিগারেট খাওয়া কমান: বেশি কফি খেলে এবং সিগারেট খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে। এগুলি এড়িয়ে চলুন।

১১) নিয়মিত ব্যায়াম করুন: ব্যায়াম ধমনীতে রক্ত চলাচল সঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং HDL-এর মাত্রা বাড়ায়।

১২) মনকে ভারমুক্ত ও শিথিল রাখুন: মানসিক চাপ কমিয়ে রাখলে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।

কোলেস্টেরল শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং নিয়ম মেনে জীবনযাপন করলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

আরো পড়ন:- ক্যালসিয়াম (calcium) কি শুধু দুধেই থাকে? জানুন বিকল্প উৎসগুলো

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা মানেই শুধু হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো নয়, বরং এটি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, উচ্চ কোলেস্টেরল অন্যান্য সমস্যার জন্ম দিতে পারে, যেমন রক্তচাপ বৃদ্ধি, রক্তনালীতে প্রদাহ, এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, যেমন লিপিড প্রোফাইল টেস্ট, করে কোলেস্টেরলের মাত্রা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। এছাড়া, খাদ্যাভ্যাসে আরও কিছু পরিবর্তন আনা যায় যেমন তাজা শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো এবং ট্রান্স ফ্যাট ও সুগারের পরিমাণ কমানো। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাইক্লিং বা সাঁতার কাটা করলে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এটি দেহের মেটাবলিজমও উন্নত করে। সব মিলিয়ে, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা শুধুমাত্র একটি অভ্যাস নয়, বরং এটি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণের প্রতিফলন যা আপনার জীবনের গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

Leave a Comment